
শাহাদাৎ হোসেন লিটন পরিচালিত অহংকার চলচ্চিত্রটি দেখে মনে হয়, এফডিসি কারখানা থেকে বহুবার পুনরুৎপাদন হওয়া কোনো চলচ্চিত্রই দেখলাম। ২০০০ সাল-পরবর্তী সময়ে যে অশ্লীল-অতিসহিংস-নকল চলচ্চিত্রের এক জমানা ছিল, সেই জমানার অন্যতম প্রতিনিধি পরিচালক লিটন ‘সুস্থ’ চলচ্চিত্র বানাতে এসেও সেই জমানার কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়েই এখনকার চলচ্চিত্রটি বানিয়েছেন। অতিরিক্ত সহিংসতা, রক্তপাত এই চলচ্চিত্রেও ছিল, যদিও অশ্লীলতা সেই অর্থে ছিল না। আর সেই সব সহিংসতা দৃশ্যায়নের যে কায়দা তা-ও এফডিসি সহিংস নির্মাতাদের উদ্ভাবিত এক চিরচেনা কায়দা, প্রচুর রক্তপাত দর্শকের মনে বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে বড়জোর, রোমাঞ্চ জাগায় না। অন্যদিকে চিত্রনাট্যের দুর্বলতার কারণে বাস্তবানুগ অনেক উপাদান থাকার পরও কাহিনি শেষ পর্যন্ত থেকে গেছে আজগুবি।
মফস্বল বা রাজধানীর উপকণ্ঠে কাহিনির প্রেক্ষাপট। এলাকায় রয়েছে এক আম্মাজান ও তার মেয়ে মায়া; যারা গরিব লোকদের টাকা ধার দেয় উচ্চহারের সুদে এবং গুন্ডাবাহিনী দিয়ে সুদ-আসলে তারা টাকা আদায় করে। এই টাকাও আদায় করে নিষ্ঠুর কায়দায়। আম্মাজান যদি হয় আগ্রাসী, মেয়ে মায়া তবে নির্মম। খেলাপিদের ঘরের জিনিসপত্র কেবল না, মানুষ ধরে নিয়ে যায়, তাদের আহত করে, নিহত করার ঘটনাও তারা ঘটায়। এসব নিয়ে ফরিয়াদ জানাতে গেলে পুলিশও তাদেরই পক্ষাবলম্বন করে। এলাকায় আরও রয়েছে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ড্রাইভারদের এক গোষ্ঠী, যাদের নেতা হলো মাহিম। গরিব শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে সুদখোরদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই মাহিমের সংঘাত বাধতে থাকে। ফলে চলচ্চিত্রটি মূলত অহংকারী মায়ার বিরুদ্ধে নীতিমান মাহিমের সংঘাতেরও কাহিনি।
তবে কাহিনির একপর্যায়ে জানা যায়, মায়া আসলে আম্মাজানের মেয়ে নয়। আম্মাজান নিঃসন্তান। আম্মাজান তার আগের জীবনে টাকার জন্য এক দম্পতিকে হত্যা করলে, সেই দম্পতির মেয়েশিশুকে লালনপালন করার দায়িত্ব নেন আম্মাজানের ভালোমানুষ স্বামী। আম্মাজানের সঙ্গে কলহের একপর্যায়ে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে স্বামীর মৃত্যু ঘটে। কিন্তু মৃত্যুর আগে স্বামী জানিয়ে যান, তিনি তাঁর সব সম্পত্তি এতিম মেয়েটিকে দান করে গেছেন। ফলে আম্মাজান বাধ্য হয়ে মেয়েটিকে বড় করতে থাকে, কিন্তু নিজের মতো করে, পাষণ্ড হিসেবে। তবে এ-ও একপর্যায়ে জানা যায় যে আসলে সম্পত্তি মায়ার নামে নেই। ফলে আম্মাজান মায়াকে ত্যাগ করে। মায়া একা একা পথে পথে ঘুরতে থাকে এবং যাদের ওপর সে এত দিন অত্যাচার করেছে, তারা তাকে এমনকি একমুঠো খাবারও দিতে অস্বীকৃতি জানায়। গতকালের ধনী মায়া ফকিরের মতো ক্ষুধার জ্বালায় পথে পথে ঘোরে। একপর্যায়ে তাকে খাবার এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় মাহিমই। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, সম্পর্ক প্রেমের দিকে গড়ায়। অমানুষ থেকে মায়া মানুষ হয়ে ওঠে। এই পর্যায়ে প্রকৃত সত্য প্রকাশিত হয় যে সম্পত্তির মালিক মায়াই। উন্মত্ত হয়ে আম্মাজান মায়াকে কিডন্যাপ করতে চায়, মাহিমের প্রতিরোধ এবং অনেক রক্তপাতের পর, সব দুষ্টুর দমন সম্পন্ন হয়। মাহিম ও মায়ার মিলন হয়।
প্রশ্ন হলো, মায়াকে আম্মাজান ত্যাগ করার পরপরই মায়া কীভাবে পথের ফকির হয়ে গেল? মায়া তো ধনীই ছিল, সাজপোশাকে ফ্যাশনেবল, আইফোন ব্যবহার করে—এত দ্রুত সে নিঃস্ব হলো কী করে? তার নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিশ্চয় ছিল, সে কি সেসব উৎস থেকে টাকা সংগ্রহ করবে না? নিদেনপক্ষে বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে টাকা পাবে না? এগুলো হলো কাহিনির চরম অসংগতির ব্যাপার। মায়াকে অসহায়-নিঃস্ব দেখাতে হলে আরও অনেক কার্যকারণ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল। অসংগতি তো আরও কত কিছুতেই আছে। সহকর্মীরা সব সিএনজিচালিত ড্রাইভার নীল ইউনিফর্ম পরে, কিন্তু নেতা মাহিম নিজের পছন্দমতো পোশাক পরে। আম্মাজানকেও কখনো সাদা চুলে, কখনো কালো চুলে দেখা গেছে।
ছোট চরিত্রগুলোও অবিকশিত থেকে গেছে। মাহিমের এক সহকর্মী সিএনজিচালিত অটোর ড্রাইভার রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ভিন্ন মানুষ হয়ে যায়, কিন্তু দিনের ভাগে সে ভালো মানুষ। এই চরিত্রটির কাহিনিতে যে রকম গুরুত্বসহ হাজির হতে পারত, পরে তা আর হয়নি। তার ভাগনি মাহিমের প্রেমে পাগল ছিল, ফর্মুলা অনুযায়ী তার মৃত্যুই কেন দেখাতে হবে? তা-ও আবার খুবই গোঁজামিল দিয়ে?
মাহিমের মতো চরিত্র শাকিব খান বহুবার করেছেন। ফলে তিনি ডালভাতের মতো অভিনয় করে গেছেন। মায়ার চরিত্রটি বরং অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল, বুবলী খারাপ করেননি। আম্মাজানের চরিত্রে নূতন চলচ্চিত্রজুড়ে চেঁচামেচি করে গেছেন। নৃশংসতার জন্য সব সময় যে চেঁচাতে হয় না, পরিচালক এই ধারণা তাঁকে দিতে পারেননি। ত্যাগী প্রেমিকার চরিত্রে তমা মির্জা মোটামুটি করেছেন, তাঁর মেকআপ চরিত্রানুযায়ী আরও কম চড়া হওয়া উচিত ছিল।
ডিজিটাল ক্যামেরার বদৌলতে ইমেজের মান ভালো এসেছে, কিন্তু আসাদুজ্জামান মজনুর ক্যামেরা পরিচালনাকৌশল গড়পড়তাই। সম্পাদনার মান বেশ খারাপ। গুন্ডাদের গাড়ি দ্রুতবেগে আসছে, এটা বোঝাতে কেন ফাস্ট ফরোয়ার্ড করাতেই হবে? গানগুলো সাধারণ মানের। স্বপ্ন ভাবনার রোমান্টিক গানগুলো কাহিনির সঙ্গে একেবারেই সুপ্রযুক্ত করা হয়নি, চরিত্র কেবল চোখ বোজে, অমনি গান শুরু হয়ে যায়। ইমন সাহার নেপথ্য সংগীত পীড়াদায়ক। অ্যাকশন দৃশ্যে নাটকীয় নেপথ্য সংগীত থাকবে, কিন্তু আমরা শুনেছি ইলেকট্রিক যন্ত্রের ঝনঝনানি।
কাহিনিতে কিছুটা বাস্তবানুগতার কথা বলেছি আগে। যেমন সিএনজিচালিত ড্রাইভার ও তাদের মহল্লা বাস্তবানুগ লেগেছে। লোকেশন বাছাই মন্দ নয়। কিন্তু কাহিনিতে কেমন তামিল-কন্নড় চলচ্চিত্রের গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছিল। এ ধরনের চলচ্চিত্র দেখার পর মনে হয়: কেবল শাকিব খানকে কাস্ট করলেই হবে না, কাহিনি মৌলিক ও বিশ্বস্ত হতে হবে। আর তার চিত্রায়ণ করার আগে চলচ্চিত্র ভাষা ও টেকনিকের ওপর দখলটা আরেকটু বাড়িয়ে নিতে হবে।